পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া 'অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলের লক্ষ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত প্রকল্পগুলোর অর্থ বিতরণের অনুমোদনে 'ধীরে চলো' নীতি গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এর ফলে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় অন্তত এক দশকের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ৮১ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন ছিল বিগত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে কোভিড-১৯ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পঙ্গু করে দিলেও সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ। এর পরের তিনটি ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে ভালো ফলাফল করেছে।
ছাত্রনেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ১৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পাস করা ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার এডিপির মধ্যে যা মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ।
আরও পড়ুন: ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন হার প্রায় শতভাগের প্রত্যাশা
আইএমইডির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিপির ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলমান ও নতুন প্রস্তাবিত সব প্রকল্প পর্যালোচনায় বিলম্বের পাশাপাশি অর্থ ছাড়ে ক্রমবর্ধমান বিলম্বকে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আইএমইডি কর্মকর্তারা। এছাড়া আগস্টের শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অনেক ঠিকাদার প্রকল্পগুলো পরিত্যাগ করেছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নগতির কথা স্বীকার করে বলেন,সরকার পরিবর্তনের কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জরুরি সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, সংশোধিত বাজেট ও সংশোধিত এডিপির পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সর্বোপরি যেসব প্রকল্প রাখতে চায় সেগুলো শেষ করার জন্য আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা করতে পারবে। কর্মসংস্থান না বাড়ালে মানুষের ভোগান্তি কমবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে এডিপি বাস্তবায়নের নিম্ন হার এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়া দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মুদ্রা সঞ্চালন বাড়ানোর লক্ষ্যে এডিপি বাস্তবায়নে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বেসরকারি খাতকে তাদের নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপ না থাকলে দেশ অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে।
সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুরু হওয়া বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
বাতিল হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকল্প, যা আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উল্লেখযোগ্য বাতিলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের জন্য একটি গ্রামীণ সংযোগ কর্মসূচি, নগর আধুনিকীকরণ প্রকল্প এবং জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্প।
আরও পড়ুন: অর্থের প্রবাহ বাড়াতে এডিপি বাস্তবায়ন দ্রুত করার উদ্যোগ সরকারের
অদক্ষতা, সক্ষমতার অভাব ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগগুলোকে প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়ার প্রাথমিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন না করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে অপচয় হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
যে তিন কারণে প্রকল্প বাতিল করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
বাজেটের সীমাবদ্ধতা: বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা সরকারের আর্থিক পরিস্থিতিকে আঁটসাঁট করেছে। মন্ত্রণালয় যুক্তি দিয়েছে যে, খাদ্য সুরক্ষা এবং জলবায়ু অভিযোজনের মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ খাতে সম্পদ পুনঃবণ্টন করা প্রয়োজন।
অদক্ষতা এবং কথিত অনিয়ম: কিছু প্রকল্প স্ফীত বাজেট, স্বচ্ছতার অভাব এবং বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে ভুগছে বলে জানা গেছে। এসব বিষয় এবং এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
জাতীয় অগ্রাধিকারের পুনর্বিন্যাস: সরকার এমন উদ্যোগগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে চায় যা সরাসরি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং টেকসই উন্নয়নকে সম্বোধন করে, যা তারা দাবি করে যে বাতিল হওয়া কিছু প্রকল্পের অভাব রয়েছে।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বাতিল হওয়া প্রকল্পগুলোর দ্বৈত চ্যালেঞ্জ এবং এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন: সংশোধিত এডিপিতে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' প্রকল্প বাদ, হতে পারে বড় সংকোচন